চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক প্রথা - মেজবানি মাংসের ইতিহাস
মেজবানি মাংসের ইতিহাস চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক প্রথা মেজবানের সাথে গভীরভাবে জড়িত। "মেজবান" ফার্সি শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ "হোস্ট" বা "অতিথি আপ্যায়নকারী"। এটি মূলত চট্টগ্রামের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত একটি ঐতিহ্যবাহী ভোজ অনুষ্ঠান।
মেজবানের প্রধান আকর্ষণ থাকে গরুর মাংসের বিভিন্ন পদ, যার মধ্যে মেজবানি মাংস অন্যতম। যদিও মেজবানের ইতিহাস বেশ পুরনো, তবে মেজবানি মাংস ঠিক কবে থেকে এই ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে, তার নির্দিষ্ট কোনো ঐতিহাসিক দলিল পাওয়া যায় না।
তবে, স্থানীয় লোককথা ও প্রবীণদের ভাষ্য অনুযায়ী, মেজবানি প্রথা শত শত বছর ধরে চলে আসছে। আগেকার দিনে, কোনো সামাজিক বা পারিবারিক অনুষ্ঠানে, যেমন - কারো মৃত্যুবার্ষিকী, বিবাহ, নতুন সন্তান জন্ম নিলে বা অন্য কোনো খুশির উপলক্ষে এই ভোজের আয়োজন করা হতো। সময়ের সাথে সাথে মেজবান চট্টগ্রামের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে।
মেজবানি মাংস রান্নার নিজস্ব একটি বিশেষ পদ্ধতি ও মশলার ব্যবহার রয়েছে, যা এটিকে অন্যান্য গরুর মাংসের পদ থেকে আলাদা করে তোলে। এই রান্নার কৌশল সম্ভবত বংশ পরম্পরায় চলে আসছে এবং স্থানীয় বাবুর্চিদের হাতে এর স্বাদ বিশেষভাবে ফুটে ওঠে।
উনিশ শতকের শেষভাগ এবং বিশ শতকের শুরু থেকে মেজবানি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়, যেখানে ধনী ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বিশাল আয়োজনে গ্রামের বা এলাকার মানুষদের আপ্যায়ন করতেন। এই অনুষ্ঠানে মেজবানি মাংস একটি অত্যাবশ্যকীয় পদ হিসেবে পরিবেশিত হতো।
বর্তমানে, মেজবানি শুধু চট্টগ্রাম নয়, সারা বাংলাদেশে পরিচিতি লাভ করেছে এবং এর স্বতন্ত্র স্বাদ ও রান্নার পদ্ধতি অনেক জনপ্রিয় হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক ও বাণিজ্যিক অনুষ্ঠানে মেজবানি মাংসের চাহিদা থাকে ব্যাপক।
সুতরাং, মেজবানি মাংসের ইতিহাস সরাসরি মেজবান নামক ঐতিহ্যবাহী ভোজ অনুষ্ঠানের ইতিহাসের সাথে জড়িত। এটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চট্টগ্রামের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
(মেজবানি মাংস) রান্নার একটি সহজ রেসিপি নিচে দেওয়া হলো:
উপকরণ:
- ১ কেজি গরুর মাংস (হাড়সহ টুকরা করা)
- পেঁয়াজ কুচি - ২ কাপ
- আদা বাটা - ২ টেবিল চামচ
- রসুন বাটা - ১ টেবিল চামচ
- পেঁপে বাটা - ২ টেবিল চামচ (মাংস নরম করার জন্য)
- হলুদ গুঁড়া - ১ চা চামচ
- মরিচ গুঁড়া - ২ চা চামচ (স্বাদমতো)
- ধনে গুঁড়া - ১ টেবিল চামচ
- জিরা গুঁড়া - ১ চা চামচ
- মেজবানি মশলার গুঁড়া - ২ টেবিল চামচ (বাজারে কিনতে পাওয়া যায় অথবা নিজে তৈরি করে নিতে পারেন)
- এলাচ - ৪-৫ টি
- লবঙ্গ - ৪-৫ টি
- দারুচিনি - ২-৩ টুকরা
- তেজপাতা - ২-৩ টি
- সরিষার তেল - ১/২ কাপ
- লবণ - স্বাদমতো
- কাঁচা মরিচ - ৪-৫ টি (ফালি করা)
- গরম পানি - প্রয়োজন অনুযায়ী
- ভাজা পেঁয়াজ (বেরেস্তা) - সাজানোর জন্য (ঐচ্ছিক)
মেজবানি মশলা তৈরির জন্য (যদি নিজে বানাতে চান):
- জিরা - ২ টেবিল চামচ
- ধনে - ২ টেবিল চামচ
- মৌরি - ১ টেবিল চামচ
- সাদা সরিষা - ১ চা চামচ
- মেথি - ১/২ চা চামচ
- রাধুনি (celery seeds) - ১/২ চা চামচ
- কালো গোলমরিচ - ১ চা চামচ
- তারা মৌরি - ১ টি
- সবুজ এলাচ - ৪-৫ টি
- লবঙ্গ - ৪-৫ টি
- দারুচিনি - ১ ইঞ্চি
- জয়ত্রী - ১/৪ চা চামচ
- জয়ফল - সামান্য (১/৮ চা চামচ)
- শুকনো লাল মরিচ - ৪-৫ টি
- তেজপাতা - ২-৩ টি
সব মশলা হালকা ভেজে গুঁড়ো করে নিন।
ধাপ ১: মাংস প্রস্তুতি ও মেরিনেশন
- প্রথমে ১ কেজি গরুর মাংস নিন। মাংসগুলো মাঝারি আকারের টুকরা করে কাটুন, হাড়সহ রাখলে স্বাদ ভালো হয়।
- মাংস ভালো করে কয়েকবার পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করুন। ধোয়ার পর একটি ছাঁকনিতে রেখে দিন, যাতে অতিরিক্ত পানি ঝরে যায়।
- একটি বড় পাত্রে ধোয়া মাংসগুলো নিন।
- এরপর একে একে ২ টেবিল চামচ আদা বাটা, ১ টেবিল চামচ রসুন বাটা এবং ২ টেবিল চামচ পেঁপে বাটা (পেঁপে বাটা মাংস নরম করতে সাহায্য করে) যোগ করুন।
- তারপর ১ চা চামচ হলুদ গুঁড়া, ২ চা চামচ মরিচ গুঁড়া (স্বাদমতো), ১ টেবিল চামচ ধনে গুঁড়া এবং ১ চা চামচ জিরা গুঁড়া মাংসের সাথে মেশান।
- সবশেষে ২ টেবিল চামচ মেজবানি মশলার গুঁড়া (যদি কেনা থাকে) অথবা আগে তৈরি করে রাখা মেজবানি মশলার গুঁড়া যোগ করুন।
- সব উপকরণ মাংসের সাথে খুব ভালোভাবে হাত দিয়ে মেখে নিন, যাতে মশলা মাংসের প্রতিটি টুকরার সাথে লাগে।
- মাংস মাখানো হয়ে গেলে পাত্রটি ঢেকে অন্তত ৩০ মিনিটের জন্য রেখে দিন। যদি হাতে সময় থাকে, তবে ১-২ ঘণ্টা মেরিনেট করলে মাংস আরও সুস্বাদু হবে।
ধাপ ২: মসলা কষানো
- একটি ভারী তলার হাঁড়ি অথবা বড় সসপ্যান চুলায় বসিয়ে মাঝারি আঁচে গরম করুন।
- হাঁড়ি গরম হলে তাতে ১/২ কাপ সরিষার তেল দিন। মেজবানি মাংসের জন্য সরিষার তেল ব্যবহার করলে এর স্বাদAuthentic হয়।
- তেল গরম হলে ৪-৫টি এলাচ, ৪-৫টি লবঙ্গ এবং ২-৩ টুকরা দারুচিনি যোগ করুন। এগুলো একটু ভেজে সুগন্ধ বের হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।
- এরপর ২ কাপ পেঁয়াজ কুচি যোগ করুন এবং হালকা বাদামী রঙ হওয়া পর্যন্ত ভাজুন। পেঁয়াজ বেরেস্তার মতো গাঢ় করে ভাজার প্রয়োজন নেই।
ধাপ ৩: মাংস কষানো
- পেঁয়াজ ভাজা হয়ে গেলে মেরিনেট করা মাংসগুলো হাঁড়িতে দিয়ে দিন।
- মাঝারি আঁচে মাংস ভালোভাবে কষাতে থাকুন। এই সময় চামচ দিয়ে ঘন ঘন নাড়াচাড়া করুন যাতে মাংস হাঁড়ির তলায় লেগে না যায়।
- কষানোর সময় মাংস থেকে পানি বের হবে এবং মশলার সাথে ভালোভাবে মিশে যাবে। ১৫-২০ মিনিট ধরে কষান, যতক্ষণ না মাংসের রং বদলাচ্ছে এবং তেল উপরে ভেসে উঠছে।
ধাপ ৪: ঝোল যোগ ও রান্না
- মাংস ভালোভাবে কষানো হয়ে গেলে স্বাদমতো লবণ এবং ৪-৫টি কাঁচা মরিচ (ফালি করা) যোগ করুন। ভালোভাবে মিশিয়ে নিন।
- এরপর মাংস সেদ্ধ হওয়ার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী গরম পানি দিন। খেয়াল রাখবেন, মেজবানি মাংসে খুব বেশি ঝোল থাকে না, সাধারণত মাখা মাখা ঝোল হয়। তাই পানির পরিমাণ বুঝে দিন।
- হাঁড়ির মুখ ঢেকে দিন এবং আঁচ কমিয়ে মাঝারি থেকে অল্প আঁচে রাখুন। মাংস নরম হওয়া পর্যন্ত রান্না করুন। গরুর মাংসের টুকরার আকারের ওপর নির্ভর করে এটি ১ থেকে ১.৫ ঘণ্টা সময় লাগতে পারে।
- রান্নার মাঝে মাঝে ঢাকনা খুলে নেড়েচেড়ে দেখুন এবং প্রয়োজন হলে অল্প গরম পানি যোগ করতে পারেন। খেয়াল রাখবেন মাংস যেন তলায় লেগে না যায়।
ধাপ ৫: পরিবেশন
- মাংস ভালোভাবে সেদ্ধ হয়ে গেলে এবং ঝোল ঘন হয়ে এলে চুলার আঁচ বন্ধ করে দিন।
- ঐচ্ছিকভাবে, পরিবেশনের আগে ভাজা পেঁয়াজ (বেরেস্তা) দিয়ে মাংস সাজাতে পারেন।
- গরম গরম মেজবানি মাংস সাদা ভাত অথবা পোলাওয়ের সাথে পরিবেশন করুন।
এই ধাপগুলো অনুসরণ করলে আপনি সহজেই মজাদার মেজবানি মাংস রান্না করতে পারবেন।
0 Comments