গরুর কালাভুনা চট্টগ্রাম অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী ও খুব জনপ্রিয় খাবার। এটি মূলত গরুর মাংস দিয়ে তৈরি একটি শুকনো, কালো রঙের ভুনা মাংসের পদ। "কালা" শব্দের অর্থ কালো এবং "ভুনা" মানে ভাজা বা কষানো। দীর্ঘ সময় ধরে মাংস কষিয়ে এবং কিছু বিশেষ মসলার ব্যবহারের কারণে মাংসের রং কালো হয়ে যায় এবং একটি বিশেষ স্বাদ তৈরি হয়।
ইতিহাস:
কালাভুনার সঠিক ইতিহাস নিয়ে তেমন কোনো সুস্পষ্ট ঐতিহাসিক দলিল পাওয়া যায় না, তবে স্থানীয় লোককথা ও প্রবীণদের ভাষ্য অনুযায়ী এর ইতিহাস বেশ পুরনো। ধারণা করা হয়, ১৭ শতাব্দীর শুরুর দিকে এই পদটির উদ্ভব হয়।
-
সংরক্ষণের পদ্ধতি: পূর্বে, যখন রেফ্রিজারেশনের ব্যবস্থা ছিল না, তখন মাংসকে দীর্ঘ সময় ধরে সংরক্ষণ করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো। কালাভুনা সম্ভবত তেমনই একটি পদ্ধতি ছিল, যেখানে মাংসকে দীর্ঘক্ষণ ধরে ভেজে মশলার সাথে মিশিয়ে রাখলে তা সহজে নষ্ট হতো না। লম্বা সময় ধরে কষানোর ফলে মাংসের জলীয় অংশ শুকিয়ে যায় এবং এটি অনেকটা শুকনো ও ভাজা ভাজা হয়ে আসে, যা প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষণে সাহায্য করত।
-
মেজবানের ঐতিহ্য: কালাভুনা চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক অনুষ্ঠান মেজবানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। মেজবানে সাধারণত বিপুল সংখ্যক লোকের জন্য খাবারের আয়োজন করা হয়, এবং কালাভুনা সেখানে একটি বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে পরিবেশিত হয়। মনে করা হয়, মেজবানের ঐতিহ্য থেকেই কালাভুনা বৃহত্তর পরিচিতি লাভ করেছে।
-
আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য: কালাভুনা রান্নার পদ্ধতি এবং ব্যবহৃত মসলা চট্টগ্রামের স্থানীয় রন্ধনশৈলীর একটি অংশ। এখানে কিছু বিশেষ স্থানীয় মসলা ব্যবহার করা হয় যা এই পদটিকে একটি স্বতন্ত্র স্বাদ দেয়।
বর্তমানে, কালাভুনা শুধু চট্টগ্রামেই নয়, ঢাকা, খুলনা, সিলেটসহ বাংলাদেশের অন্যান্য শহরেও অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি খাবার। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, বিয়ে, ঈদ এবং রমজানের সময় ইফতার ও সেহরিতেও এটি একটি প্রিয় খাবার হিসেবে পরিবেশিত হয়। সময়ের সাথে সাথে এর জনপ্রিয়তা বেড়েছে এবং এটি এখন একটি ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশি মাংসের পদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
সংক্ষেপে, গরুর কালাভুনা চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী খাবার, যার উৎপত্তি সম্ভবত মাংস সংরক্ষণের প্রয়োজন থেকে হয়েছিল এবং যা মেজবানের মাধ্যমে বৃহত্তর পরিচিতি লাভ করে। এর বিশেষ স্বাদ এবং রান্নার পদ্ধতি এটিকে একটি স্বতন্ত্র স্থান দিয়েছে।
গরুর কালাভুনা রান্নার উপকরণ:
- ১ কেজি হাড়সহ গরুর মাংস (ছোট বা মাঝারি টুকরা)
- ১ কাপ পেঁয়াজ কুচি
- ১/২ কাপ পেঁয়াজ বাটা
- ২ টেবিল চামচ আদা বাটা
- ১ টেবিল চামচ রসুন বাটা
- ১ চা চামচ হলুদ গুঁড়া
- ২ চা চামচ মরিচ গুঁড়া (স্বাদমতো)
- ১ টেবিল চামচ ধনে গুঁড়া
- ১ চা চামচ জিরা গুঁড়া
- ১/২ চা চামচ রাঁধুনি গুঁড়া (ঐচ্ছিক, তবে কালাভুনার বিশেষ স্বাদ আনে)
- ৪-৫ টি এলাচ
- ৩-৪ টি লবঙ্গ
- ২-৩ টুকরা দারুচিনি (মাঝারি)
- ২ টি তেজপাতা
- ৩-৪ টি শুকনো মরিচ (আস্ত)
- ১/২ কাপ সরিষার তেল (কালাভুনার জন্য এটি সেরা)
- স্বাদমতো লবণ
- গরম পানি (প্রয়োজন অনুযায়ী)
- ভাজা পেঁয়াজ (বেরেস্তা) - সাজানোর জন্য (ঐচ্ছিক)
গরুর কালাভুনা রান্নার প্রণালী :
ধাপ ১: মাংস প্রস্তুতি ও মেরিনেশন
- প্রথমে গরুর মাংস ভালো করে ধুয়ে নিন এবং অতিরিক্ত পানি ঝরিয়ে ফেলুন।
- একটি বড় পাত্রে মাংসের সাথে পেঁয়াজ বাটা, আদা বাটা, রসুন বাটা, হলুদ গুঁড়া, মরিচ গুঁড়া, ধনে গুঁড়া, জিরা গুঁড়া এবং রাঁধুনি গুঁড়া (যদি ব্যবহার করেন) দিয়ে ভালোভাবে মেখে নিন।
- স্বাদমতো লবণ যোগ করে মাংসের সাথে মিশিয়ে নিন।
- মাংস মেরিনেট করার জন্য অন্তত ১-২ ঘণ্টা রেখে দিন। সম্ভব হলে সারারাত মেরিনেট করলে স্বাদ আরও ভালো হয়।
ধাপ ২: তেল গরম ও মসলা ফোঁড়ন
- একটি ভারী তলার কড়াই অথবা হাঁড়িতে সরিষার তেল গরম করুন।
- তেল গরম হলে আস্ত এলাচ, লবঙ্গ, দারুচিনি, তেজপাতা এবং শুকনো মরিচ দিয়ে কয়েক সেকেন্ড ভেজে সুগন্ধ বের হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। খেয়াল রাখবেন মসলা যেন পুড়ে না যায়।
ধাপ ৩: পেঁয়াজ কুচি ভাজা
- এবার তেলে পেঁয়াজ কুচি দিয়ে দিন এবং মাঝারি আঁচে হালকা বাদামী রঙ হওয়া পর্যন্ত ভাজুন।
ধাপ ৪: মেরিনেট করা মাংস কষানো
- পেঁয়াজ ভাজা হয়ে গেলে মেরিনেট করা মাংস কড়াইয়ে দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে নিন।
- মাঝারি আঁচে মাংস কষাতে থাকুন। এই সময় চামচ দিয়ে ঘন ঘন নাড়াচাড়া করুন যাতে মাংস পাত্রের তলায় লেগে না যায়।
- মাংস থেকে পানি বের হবে এবং মশলার সাথে ভালোভাবে মিশে যাবে। প্রায় ২০-২৫ মিনিট ধরে কষান যতক্ষণ না মাংসের রং কিছুটা পরিবর্তন হয় এবং তেল উপরে ভেসে ওঠে।
ধাপ ৫: পানি যোগ ও রান্না
- মাংস ভালোভাবে কষানো হয়ে গেলে প্রয়োজন অনুযায়ী গরম পানি যোগ করুন। কালাভুনায় সাধারণত খুব বেশি ঝোল থাকে না, তবে মাংস সেদ্ধ হওয়ার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই দিন।
- হাঁড়ির মুখ ঢেকে দিন এবং আঁচ কমিয়ে মাঝারি থেকে অল্প আঁচে মাংস নরম হওয়া পর্যন্ত রান্না করুন। গরুর মাংসের টুকরার আকারের উপর নির্ভর করে এটি ১ থেকে ১.৫ ঘণ্টা সময় লাগতে পারে। মাঝে মাঝে নেড়েচেড়ে দেখুন।
ধাপ ৬: মাংস ভাজা ও কালো করা
- যখন মাংস ভালোভাবে সেদ্ধ হয়ে যায় এবং ঝোল প্রায় শুকিয়ে আসে, তখন চুলার আঁচ বাড়িয়ে দিন এবং অনবরত নাড়তে থাকুন।
- এই পর্যায়ে মাংস ভাজা হতে শুরু করবে এবং ধীরে ধীরে এর রং কালো হতে থাকবে। খেয়াল রাখবেন যাতে মাংস পুড়ে না যায়।
- মাংস যখন কালচে ভাজা ভাজা হয়ে যায় এবং তেল উপরে ভেসে ওঠে, তখন বুঝবেন কালাভুনা হয়ে গেছে।
ধাপ ৭: পরিবেশন
- চুলার আঁচ বন্ধ করে দিন এবং পরিবেশনের আগে ভাজা পেঁয়াজ (বেরেস্তা) দিয়ে সাজিয়ে গরম ভাত, পোলাও বা পরোটার সাথে পরিবেশন করুন।
এই প্রণালী অনুসরণ করে আপনি সুস্বাদু গরুর কালাভুনা রান্না করতে পারবেন। রাঁধুনি গুঁড়া কালাভুনার একটি বিশেষ উপকরণ, তাই সম্ভব হলে এটি ব্যবহার করার চেষ্টা করুন
0 Comments